এমন এসপি আর দেখিনি !
রাত ৯টায় জরুরি রোলকল, থানার সামনে খোলা জায়গায় বৈদ্যুতিক আলোয় সারিবদ্ধভাবে দন্ডায়মান আমরা সকল অফিসার ফোর্স।সম্মুখ থেকে সম্মানিত ওসি স্যার সংবাদ দিলেন অত্র জেলার মাননীয় পুলিশ সুপার মহোদয় কচুয়া থেকে রওয়ানা করেছেন হাজীগঞ্জের উদ্দেশ্যে। অধীর আগ্রহে অপেক্ষমাণ আমরা। বারবার থানার প্রধান ফটকের দিকে চোখ যাচ্ছে, দুয়েকটা সিএনজি অজ্ঞাত উদ্দেশ্যে থানায় প্রবেশ করলে তদন্ত স্যার তাৎক্ষণিক সরিয়ে দিয়ে প্রবেশপথ ক্লিয়ার করলেন। ক্ষণিকবাদে হুটারের শব্দ কর্ণগোচর হলে ওসি স্যার সকলকে সাবধানে দাঁড় করিয়ে দেন। সাদা পাজেরোতে চড়ে অবশেষে আগমন করলেন চাঁদপুর জেলা পুলিশের সম্মানিত অভিভাবক, সকলের আস্থার মধ্যমণি, আদর্শ পুলিশের প্রতিমূর্তি জনাব মাহবুবুর রহমান পিপিএম (বার) স্যার।
>>>গাড়ি থেকে নেমে ওসি স্যারের সাথে স্যালুট বিনিময় পর্ব সেরে আমাদের দিকে মুখ করে দাঁড়িয়েছেন স্যার৷ শুরু করলেন আমাদের কুশলাদি জিজ্ঞাসার মাধ্যমে। তিনটি বার্তা নিয়ে এসেছেন স্যার আমাদের জন্য৷
প্রথমত নিজের পদোন্নতির সুসংবাদটি আমাদেরকে দিতে গিয়ে স্যার বলেন “তোমরা হয়তো শুনেছো,আল্লাহর অশেষ কৃপায় এবং তোমাদের দোয়ায় আলহামদুলিল্লাহ অতিরিক্ত ডি আই জি হিসেবে আমার পদোন্নতি হয়েছে”৷
দ্বিতীয়ত…..এবার কিছুটা থেমে গেলেন। চশমার গ্লাসের অন্তরালে চোখদুটি কিছুক্ষণের জন্য বন্ধ করে রাখলেন, মুখমণ্ডলটা আমাদের থেকে একটু উপরের দিকে করে কিছু একটা গোপন করার আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছেন স্যার। ডান হাত দিয়ে বুকের বাঁ পাশটা চেপে ধরলেন, কিছু একটা বলার চেষ্টা করছেন, কিন্তু কেন জানি শব্দ হচ্ছেনা৷ কন্ঠস্বর বেশ ভারী হয়ে গেল৷ বারবার চোখের পলক ফেলছেন, চশমার ফ্রেমের নিচ দিয়ে গাল বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে৷ থানার ওসি স্যার থেকে শুরু করে সকল অফিসার ফোর্স নিঃশব্দে সব অবলোকন করছেন৷ সবকিছু নিরব, নিথর, নিস্তব্ধ। ধরা গলায় স্যার বলছেন,” খুব শীঘ্রই হয়তো অন্যত্র বদলি হয়ে যাবো, তোমাদের ছেড়ে পাড়ি দিতে হবে নতুন গন্তব্যে, দায়িত্ব পালনে সকলের সুবিধামতো হয়তো সবকিছু দিতে পারিনি, তবে আল্লাহকে হাজির নাজির করে বলছি তোমাদের সুযোগ সুবিধার বিচারে সর্বোচ্চ স্বচ্ছতা ও নিরপেক্ষতা অবলম্বন করেছি৷ তবুও কর্তব্য পালনে যদি কারো মনে কখনো সামান্যতম আঘাত দিয়ে থাকি তাহলে তোমরা তোমাদের এই অভিভাবককে ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখো”।
কথা গুলো বলতে স্যারের খুব কষ্ট হচ্ছিল, কোথায় যেন একটা আত্মার টান পড়ে গেছে আমাদের প্রতি। একটা অদৃশ্য মায়া বারবার কেন জানি স্যারকে অশ্রুসিক্ত করে তুলছে, স্যারের চেহারার দিকে তাকাতে আমাদেরও সাহস হচ্ছেনা৷ নিজের অজান্তেই ভেতরটা হুহু করে উঠছে বারংবার, এক আবেগঘন পরিবেশে আমরা সকলে দাঁড়িয়ে। ওসি স্যার, তদন্ত স্যারকে দেখেছি মাথা নিচু করে গোপনে চোখ মুছতে।
স্যারের তৃতীয় কথাটি ছিল,”আমার পরে যিনি তোমাদের অভিভাবক হয়ে আসবেন তিনি নিশয়ই আমার চেয়ে অনেক বেশি যোগ্য ও দক্ষ হবেন৷ আমার চেয়ে অনেক বেশি ভালো হবেন, তোমরা উনাকে সার্বিক সহযোগিতা করো। জেলা পরিচালনায় দায়িত্ববোধ নিয়ে উনার চলার পথকে সুগম করে দিও। আমার জন্য সকলে দোয়া করো”। অবশেষে সকলের মঙ্গল কামনা করছি বলে ওসি স্যারকে রোলকল ব্রেক করার নির্দেশ দিলেন।
স্যার বিদায় নেয়ার পর, আমরা একে অপরের দিকে চাওয়া চাওয়ি করছিলাম, দুয়েকজন সশব্দে নাক টানছেন, কারো কারো চোখ ভেজা,আবার কেউ কেউ হাতদিয়ে চোখ কচলাচ্ছেন। স্বাভাবিক আলাপচারিতা নেই, একটা বিদায়ী শোকের মাতম বিরাজ করছে সবার মাঝে। থানার সর্বজ্যেষ্ঠ এস আই আব্দুল আলিম গলার স্বর বড় করলেন, বললেন, আমার ২২বছরের চাকরি জীবনে এমন এস পি পাইনি। পাশ থেকে অন্যএকজন বলে উঠলেন, স্যারের কাছে পারিবারিক বা শারীরিক সমস্যার কথা বলে কেউ কখনো হতাশ হননি৷ এভাবে একেকজন একেক মন্তব্য করে যাচ্ছেন। এমন এস পি’ মহোদয়ের সান্নিধ্যে চাকরি করা সৌভাগ্যের ব্যাপার, স্যারকে বিদায় জানাতে বোধহয় আমরা কেউই প্রস্তুত ছিলাম না। থানার সকল অফিসার ফোর্সদের মধ্যে একটা গুঞ্জন ধ্বনিত হচ্ছে বারবার, এমন এস পি আর দেখিনি।
আল্লাহ স্যারকে সবসময় যথাযথ সম্মানের সহিত রাখুক, শারীরিক সুস্থতা দান করুক, সর্বোপরি স্যার ও স্যারের পরিবারের সকলের মঙ্গল কামনা করছি।
এস আই রবিউল ইসলাম
হাজীগঞ্জ থানা, চাঁদপুর
২২/০১/২০২১