কাজী নজরুলের বিদ্রোহী সত্ত্বা
আমাদের কবি কাজী নজরুল ইসলামের সাথে একবাক্যে বিদ্রোহী শব্দটি জুড়ে দেওয়া হয় এবং এটি সবক্ষেত্রে সত্যি না হলেও অর্থাৎ তিনি কবিতায় প্রতিবাদমূলক শব্দগুলো ব্যবহার করার সাথে সাথে প্রেম ও শিশুদের জন্য মজার মজার ছড়াও লিখেছেন যা অত্যন্ত জনপ্রিয়। যদিও সেসব ছাপিয়ে তার বিদ্রোহী সত্ত্বাই প্রগাঢ় এর কারণ মনে হয় বহু সংখ্যক সাধারণ মানুষের বুকের চেতনাটুকু শব্দ হয়ে তার কবিতায় ধরা দেয়। বাংলায় ’বিদ্রোহী’ শব্দের অর্থ হলো প্রচলিত বা বর্তমান অসঙ্গতির বিরুদ্ধে যাওয়া, প্রতিরোধ করা, প্রতিবাদ করা, বিরোধিতা করা,অগ্রাহ্য করা ইত্যাদি। সমাজে বিদ্রোহী বা প্রতিবাদী অনেকেই থাকেন, যুগে যুগে জন্মগ্রহণ করেন। তবে সকলের বিদ্রোহ করার বা বিরোধীতা করার পন্থা একরকম হয় না। কেউ গানে, কেউ কবিতায়, কেউ অভিনয়ে আবার কেউ স্লোগানে বিরোধীতা করেন। এসব করতে গিয়ে তাকে অত্যাচার সহ্য করতে হতে পারে। ব্রিটিশদের কাছ থেকে মুক্ত হতে কত শত বিদ্রোহী নরনারীর জীবন গেছে, অত্যাচারিত হয়েছেন। আবার পাকিস্তানের শোষকদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ হয়েছে,সংগ্রাম হয়েছে। আবার একটি সমাজের আদর্শিক বিচারে যখন একপেশে শক্তিমত্তা ভর করে তখন তার বিরুদ্ধেও বিদ্রোহ হয়। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিদ্রোহী কবি হিসেবে সমধিক পরিচিত হলেও তার বিদ্রোহ শব্দটি প্রকৃতপক্ষে ছিল সমাজের অসাম্যের বিরুদ্ধে। আমরা সমাজটাকে এক ধরনের কুক্ষিগত করে রেখেছি। অনেক চেষ্টা করেও কবি সমাজকে সেই অসাম্য থেকে মুক্ত করতে পারেননি। পারেননি ঠিকই তবে তার সেই চেষ্টা, শব্দের বলিষ্ঠ উচ্চারণ যা কি না কোনো মিসাইলের চেয়েও শক্তিশালী সমাজে আজও বহমান। কবির ’বিদ্রোহী’ কবিতায় যে শব্দুগুলোর প্রয়োগ করেছেন সেই শব্দগুলো নিয়ে আলোচনা করলে বিদ্রোহের স্বরুপ বের হয়ে আসে। প্রতিটি লাইনেই একাধিক শব্দ আনা হয়েছে যা বিদ্রোহের প্রতীক এবং আগুন ঝরায়। কবিতার শুরুতেই একজন বীরের যে তার শির বা মাথা সর্বদা উঁচু রাখে তার কথা বলা হয়েছে। এরপর পর্যায়ক্রমে ;শিখর হিমাদ্রির (হিমালয় পর্বতের চূড়া), রুদ্র ভগবান (ঈশ^রের রুদ্র রুপ), চিরদুর্দম (যাকে দমানো যায় না),দুর্বিনীত (এখানে এই শব্দটির অর্থ হলো অন্যায়ের সাথে আপোষ না করা), নৃশংস,নটরাজ (নটরাজ অর্থ ভগবান শিব), সাইক্লোন (প্রচন্ড ঝড় বিশেষ), ধ্বংস,মহাভয় (ভয়ের অধিক),অভিশাপ পৃথ্বীর (পৃথিবীর অন্যায়ের বিরুদ্ধে অভিশাপ), দুর্বার,উচ্ছৃখল,টর্পেডো (অস্ত্র বিশেষ), ভাসমান মাইন (অস্ত্র বিশেষ), এলোকেশে ঝড়,ঝঞ্ঝা,ঘূর্ণি,নৃত্য-পাগল ছন্দ,মুক্ত জীবনানন্দ (আনন্দ উচ্ছাস বাধাহীন),চল-চঞ্চল,উন্মাদ,মহামারী,ভীতি,শাসন-ত্রাসন,সংহার,উস্ন,হোম-শিখা,সাগ্নিক জমদগ্নি (একজন মহর্ষি যিনি বর্তমান মন্বন্তরের সপ্তর্ষিদের একজন),যজ্ঞ,পুরোহিত (হিন্দুদের পূজা-অর্চনা যিনি করেন),অগ্নি,শ্মশান,নিশাবসান (রাত্রির অবসান),ইন্দ্রানী সুত (দেবরাজ ইন্দ্রের স্ত্রী এবং তার পুত্রের নাম জয়ন্ত),রণ তূর্য (যুদ্ধ ঘোষণা করার সময় যে শিঙা বাজানো হতো), ব্যোমকেশ (শিব), বন্ধন হারা ধারা গঙ্গোত্রীর , চেঙ্গিস (একজন যোদ্ধা), বজ্র, ওঙ্কার,ইস্রাফিলের শিঙ্গার মহা হুঙ্কার, শিবের ডমরু ত্রিশূল (ভগবান শিবের হাতের বাদ্যযন্ত্র ও অস্ত্র), ধর্মরাজের দন্ড,চক্র ও মহাশঙ্খ (ভগবান নারায়ণের হাতে থাকে), ক্ষ্যাপা দুর্বাসা (সনাতন ধর্মের একজন ঋষি যিনি তার ক্রোধের জন্য সমধিক পরিচিত ছিলেন), দাবানল,রাহু গ্রাস,দর্পহারী, বিধাতার বুকে ক্রন্দন-শ^াস, উত্থান-পতন, বৈজয়ন্তী (পতাকা), আগ্নিয়াদ্রি,ভূমিকম্প, অর্ফিয়াসের বাঁশরী (অর্ফিয়াস প্রাচীন গ্রীক ধর্মের কিংবদন্তী সঙ্গীতশিল্পী,কবি এবং ধর্মগুরু), শ্যামের হাতের বাঁশরী (শ্যাম অর্থাৎ ভগবান শ্রীকৃষ্ণের হাতের বাঁশি), শ্রাবণ-প্লাবন বন্যা,অন্যায়,উল্কা,শনি,ধূমকেতু-জ¦ালা,বিষধর কাল-ফণী,ছিন্নমন্ডা চন্ডী (হিন্দু ধর্মের দেবী মা কালিকার উগ্র রুপ বিশেষ),রণদা সর্বনাশী, মৃন্ময়-চিন্ময়, অব্যয়, দুর্জয়,পুরুষোত্তম সত্য (যা অপেক্ষা আর সত্য নেই),পরশুরামের কঠোর কুঠার (সনাতন ধর্মের একজন অবতার। যার হাতের কুঠার দ্বারা ২১ বার পৃথিবী ক্ষত্রিয় শূণ্য হয়েছিল),বলরাম স্কন্ধ (ভগবান শ্রীকৃষ্ণের ভ্রাতা এবং বিষ্ণুর অবতার ও তার কাঁধ যে কাঁধে নাঙ্গল থাকে),বিদ্রোহী ভৃগু ,স্রষ্টা-সূদন, চির-বিদ্রোহী বীর। বিদ্রোহী শুধু একটি কবিতা নয়, একটি মামুলি শব্দ নয় এটি একটি ইতিহাস। বিদ্রোহী কবিতা পড়ে বিদ্রোহী কবিতার শব্দের মতো কখনো চিরদুর্দম,দুর্বিনীত হতে ইচ্ছে করে,কখনো টর্পেডো,ভাসমান মাইন আবার কখনো তীব্র ঘূর্ণিঝড়ের মতো প্রলয় বাতাস হতে ইচ্ছে করে পাঠক মন। দেখতে দেখতে এখন কবিতাটি শতবর্ষ পেরিয়ে গেছে। অথচ বিদ্রোহী কবিতার আবেদন কমেনি একটুও। বিপরীতে ক্রমেই যেন এই কবিতা বেশি প্রাসঙ্গিক হচ্ছে। বিদ্রোহী তুমুল জনপ্রিয় ছিল তার প্রথম প্রকাশের সময় থেকেই।
তিনি শিখিয়েছেন কিভাবে শির উচু করে সমাজে বাঁচতে হয়। মাথা তুলে দাড়াতে হয়। শৃঙ্খল ভাঙার সাহস তার কবিতা জুগিয়ে আসছে। চেতনার বোধদয় বলতে আমরা যা বুঝি তা কাজী নজরুল ইসলামে কবিতায় রয়েছে। তার বিদ্রোহী কবিতার লেখনী যেন এক শাণিত অস্ত্র। কবিতার প্রতিটি শব্দ যেন শাসকের বিরুদ্ধে একটি প্রতিবাদী বারুদ। পড়লেই দপ করে ভেতরে আগুন জ¦লে ওঠে। বিদ্রোহী কবিতার শুরুতেই তিনি লিখেছেন, বল বীর/বল উন্নত মম শির/শির নেহারি আমারি নতশির ওই শিখর হিমাদ্রির! এই বীর তিনি নিজেই। অথবা বিশ^জুড়েই যেখানে আজ সাম্প্রদায়িক অস্থিতিশীলতা, অরাজকতা, রক্তপাত, ধর্মের দোহাই দিয়ে অন্য ধর্মের মানুষের প্রতি হিংসা বিদ্বেষ ছড়ানোর ঘটনা- আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম ছিলেন এইসব থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত, স্বচ্ছ এক মানুষ। যার বিদ্রোহ ছিল শাসকের বিরুদ্ধে, প্রথাগত শৃঙ্খলের বিরুদ্ধে,কুসংস্কারের বিরুদ্ধে, অসাম্য নীতির বিরুদ্ধে,বর্ণ বৈষম্যের বিরুদ্ধে,জাতিগত বিভেদের বিরুদ্ধে,ক্ষমতার অপব্যবহারের বিরুদ্ধে। তবে এমন নয় যে তার ’বিদ্রোহী’ কবিতা নিয়েও কোনো সমালোচনা হয়নি। সমালোচনা হয়েছে। অনেকেই ছিলেন এই দলে। কিন্তু তিনি বাধা ভাঙার পথেই এগিয়েছেন। যে বাধা আমরা আমাদের সমাজে আজও ভাঙতে পারিনি, যে কুসংস্কার আজও সমাজে সংস্কার রুপে প্রভেদ সৃষ্টিতে ব্যস্ত সেই শৃঙ্খল আমরা না ভাঙতে পারলেও তিনি ভেঙেছিলেন তার কবিতায়। ’বিদ্রোহী’ কবিতার লক্ষণীয় বিষয় হলো কবিতার প্রতিটি লাইনেই এমন সব শব্দের ব্যবহার যেখানে শরীরের প্রতিটি রক্তকণিকায় গতি আনে। আঘাত করে হৃদয়ের ঘুমিয়ে থাকা মনুষ্যত্বে। প্রতিটি শব্দেরই আছে নিজস্ব ক্ষমতা। প্রতিটি শব্দই প্রতিবাদ করতে শেখায়। কিন্তু প্রশ্ন হলো কবি কেন এতটা বিদ্রোহী হয়ে উঠলেন? শৈশব থেকে ঘর পালানো,স্কুল পালানো কবি যুদ্ধও করেছেন। খুব কাছ থেকে দেখেছেন সমাজের রেষারেষি,সমাজের ধনী-দরিদ্রের ব্যবধান,খুব কাছ থেকে পৃথিবীর হিংস্র দিকটাও দেখেছেন। এর ফলে কবির ভেতরে একজন মানুষের জন্ম হয়েছে। তিনি বারবার ব্যবহার করেছেন ’আমি’ শব্দ। সেই আমি শুধু কবি নিজে, আমাদের ভেতরেও সেই মানুষ আছে। দীর্ঘ বিদ্রোহী’ কবিতার প্রতিটি লাইনেই এত এত উপমাবাচক শব্দের ব্যবহার অন্য আর কবিতায় সচরাচর দেখা যায় না। তবে পুরো কবিতায় একটাই শিক্ষা রয়েছে। সেটি হলো, একজন বিদ্রোহীর মাথা কখনো নত থাকে না। শত প্রতিকূল অবস্থাতেও তার মাথা থাকবে উুঁচু, চির উন্নত।
অলোক আচার্য
প্রাবন্ধিক