মা আমার প্রথম শিক্ষালয়
মনিরুজ্জামান বাবলু চাঁদপুর
Link Copied!
রাত একটায় ঘুম ভেঙে গেল। ঘুম আর আসছে না। মনে পড়ছে মা আর বাবার কথা। মায়ের শারীরিক অবস্থা ভালো যাচ্ছে না। বাবার চোখে অপারেশন করানো হলো। কি জানি কেন যেন বারবার মনটা ছুটেছে শুধু মা-বাবার কাছে। তাঁদের সাথে আজ দিনে মুঠোফোনে কথাও হয়নি। খুব ভয় ভয় লেগেছে। ছোট ভাই রাজীবের ফেসবুক সচল দেখলাম।
তাই মনের ভয়ে ম্যাসেঞ্জারে জানতে চাইলাম, এখনো ঘুমাসনি কেন? আব্বা-আম্মা কেমন আছেন? কোনো উত্তর পেলাম না। কিছুক্ষণ পর তার ফেসবুক লাইন অফ হয়ে গেল। ফজরের নামাজ পড়ে মা-বাবার জন্য সৃষ্টিকর্তার কাছে দু হাত তুলে সুস্থতার জন্য দোয়া চাইলাম। সহধর্মিণীকে বলেছি, তুমিতো ঘুমিয়ে ছিলে আর আমি রাত একটার পরও ঘুমাতে পারিনি। সেও কারণ জানতে চাইলো। বললাম, মা-বাবাকে খুব মনে পড়ছে। সকালে শ্বশুরালয় থেকে রওনা হয়ে বাসায় ফিরলাম। মা-বাবার সাথে দেখা করার পর একটা স্বস্তি ফিরেছে মনে। এটা আমার মা-বাবার প্রতি ভালোবাসার গল্প।
একদিন আমার সহধর্মিণীও বলেছিল, ‘আমার মা-বাবার জন্যে মন কাঁদছে।’ এভাবেই প্রত্যেক নর-নারীর জীবনে জন্মধারণী ও জন্মদাতার প্রতি ভালোবাসার ভিন্ন ভিন্ন অনুভূতি রয়েছে। প্রসঙ্গ আমার পড়াশোনায় মায়ের অবদান। আজকাল ঘরে ঘরে লেখাপড়ায় মায়ের অবদান আর আমাদের ঘরে লেখাপড়ায় মায়ের অবদানের স্মৃতি পুরোপুরি ভিন্নতা রয়েছে। বাবা সরকারি চাকুরিজীবী ছিলেন। সেই সুবাদে বাড়িতে বেশি থাকা পড়তো না। মায়ের কাছেই কেটেছে ছোটবেলার প্রতিটি মুহূর্ত। মা-বাবার বড় সন্তান আমি। আমরা দুই ভাই ছিলাম এক বছরের বড়-ছোট।
স্কুল জীবন শুরু করার পূর্বে স্বর ও ব্যঞ্জণবর্ণ মায়ের হাতে শেখা। মা আমার প্রথম শিক্ষালয়। কানের লতি ধরতে পারিনি বলে প্রথম শ্রেণিতে ভর্তি হতে পারলাম না। শিশু শ্রেণিতে যখন প্রধান শিক্ষক ক্লাসে এসে পাঠদানের সময় বলেছিলেন, যে ‘আম’ বানান করতে পারবে, তাকে একটি বই পুরস্কার দেয়া হবে। প্রধান শিক্ষক বলার সাথে সাথেই আমি হাত ওঠালাম। বললাম, আ+ম = আম। স্যার আমাকে ছুটির পর অফিসকক্ষে যেতে বললেন। আমি গেলাম। স্যার আমাকে প্রথম শ্রেণির বাংলা ‘আমার বই’ উপহার দিলেন। প্রথম শ্রেণিতে ভর্তি হতে পারলাম না, সেই কষ্ট ভুলে গেলাম।
খুশিতে এক দৌড়ে বাড়িতে এসে মায়ের কোলে উঠে গেলাম। মা, স্যার আমাকে বই দিয়েছে। সারাদিন মায়ের কাছে বসে নতুন বই পড়লাম। নতুন বই পেয়ে ওইদিন সন্ধ্যায় আর চোখে ঘুমও আসেনি। মা আমাকে ছোট ছোট কবিতা, ছড়াগুলো পড়ে পড়ে শোনালেন। মাঝে মাঝে বানান করে পড়তে বললেন। বই দেখে দেখে লেখতে বলেছিলেন। মনে পড়ে সেই দিনের খড়িমাটি (চক) আর সস্নেটের কথা। এক টাকা দিয়ে দুইটা চক। নোয়াবাজার কিংবা উয়ারুক বাজারের দিন আসলে দাদাকে চক আনতে বলতেন মা। আর মাসে অন্তত একটি সস্নেট লাগতো। প্রতিদিন সন্ধ্যায় মাগরিবের নামাযের পর পড়ার টেবিলে বসতে মায়ের বকুনি। হারিকেনের ছিমনি পরিষ্কার করে কেরোসিন ঢেলে জ্বালিয়ে দিতেন মা।
পড়ার টেবিলে বসতাম। মা পাশে বসতেন। নারকেলের শলার মুঠো ছিলো মায়ের হাতে। চোখে ঘুম ধরলে আচমকা শলার মুঠি দিয়ে আঘাত করে জাগিয়ে দিতেন। কোন ক্লাসে কত বিষয় বই_ মা তা বুঝতেন। কয় বিষয় পড়েছি, কোন কোন বিষয়ের হাতের লেখা আছে তার খোঁজ নিতেন। পরীক্ষার সময় ডিম আর দুধ ছিলো স্পেশাল খাবার। তখন একটু যত্ন ছিল বেশি। ডিম খেলে ডিম পাবো_মায়ের মনে এমন সংস্কার ছিলো না। একদিন স্কুল ছুটির পর এসে দেখি মা খুব অসুস্থ। বই রেখে মায়ের পাশে বসে অনেক কেঁদেছি। মা কোনো কথা বলেনি।
মা-বিহীন শৈশবের দিনগুলো কোথাও কাটাতে পারতাম না। পরীক্ষার ফলাফল ঘোষণার দিন মা সাথে যেতেন। মেট্রিক পরীক্ষার পূর্বেই পড়াশোনার জন্যে মায়ের কাছ থেকে দূরে চলে এলাম। মা যদি পাশে বসে না পড়াতেন, যদি পড়ালেখায় তাগিদ না দিতেন_তাহলে কি আমি উন্মুখ হয়ে পড়তাম? বাবা টাকা পাঠাতে দেরি হলে মা হাঁস-মুরগীর ডিম বিক্রি করে প্রাইভেট মাস্টারের পাওনা পরিশোধ করতেন। আমার মায়ের হাত ধরেই আমি বর্ণমালা শিখেছি। খুব বেশি মনে পড়ে মা প্রথমে ‘অ’ লিখে দিতেন। পরে মা আমার হাতে চক ধরিয়ে দিয়ে আবার ওই ‘অ’ এর উপর হাত ঘোরাতে বলতেন। এভাবে ১, ২।
এভাবে এ বি সি ডি। একটা সময় আমার হাতেই বাবার কাছে চিঠি লিখতে বলতেন মা। মা আমার প্রথম শিক্ষালয়। মা আমার প্রথম শিক্ষাগুরু। মা আমায় প্রথম শিক্ষা দিলেন, ‘পড়ালেখা করে যে, গাড়ি-ঘোড়ায় চড়ে সে।’
লেখক : সম্পাদক, ডাকাতিয়া; হাজীগঞ্জ।