জীবনানন্দের ‘রূপসী বাংলা’: চিরায়ত বাংলার প্রচ্ছদ

আবু আফজাল সালেহ
আপডেটঃ এপ্রিল ২০, ২০২৩ | ১:৫৬
আবু আফজাল সালেহ
আপডেটঃ এপ্রিল ২০, ২০২৩ | ১:৫৬
Link Copied!

বাংলার প্রকৃতিকে জীবনানন্দ দাশ (বরিশাল, ১৭ ফেব্রুয়ারি ১৮৯৯-কলকাতা, ২২অক্টোবর ১৯৫৪) ভালোভাবেই পর্যবেক্ষণ করেছেন। তারপর অসাধারণ দক্ষতায় কবিতায় তুলে ধরেছেন। প্রকৃতিকেই অনেকেই তুলে ধরেছেন বা ধরতে চেয়েছেন,কিন্তু জীবনানন্দের পর্যবেক্ষণ ও প্রয়োগের মধ্যের যথার্থতা প্রায় নিখুঁত। আর এ-নিখুঁত প্রতিচ্ছবি (যা পূর্ববাংলার প্রতিনিধি) চমৎকারও বটে। পঞ্চইন্দ্রিয়ের সর্বোচ্চ ব্যবহার পাঠককে মুগ্ধ করে। প্রকৃতি বর্ণনায় ওয়ার্ডসওয়ার্থের মতো সরল কিন্তু
জীবনানন্দ আরও পরিষ্কার, আরও যথার্থ বা জীবন্ত-কিন্তু কোমল আবহে। উপমা, অলংকার মিলিয়ে সুন্দর চিত্রকল্পগুলি পূর্ববাংলার (এমনকি পশ্চিমবঙ্গের) প্রচ্ছদই বলা যেতে পারে। এ-কাব্যের সনেটগুলিতে আছে মধুকূপী ঘাস, নাটাফল, কাঁঠাল প্রভৃতি গাছগাছালি। গঙ্গাফড়িং, শালিক, খঞ্জনা, চড়ুই, মৌমাছি, প্রজাপতি ইত্যাদি প্রাণ দখল করেছে কবিতার শরীরে। নীলাভ আকাশ যেমন রয়েছে, আরও রয়েছে সজনে ফুল, শিশির, কিশোরীর আঁচল, রাঙা লিচু, ডুমুরের সোঁদা গন্ধ, সরষে খেত, শামুক, গুগলি ইত্যাদির কথা। কর্ণফুলী, রূপসা, ধলেশ্বরী, পদ্মা, জলঙ্গী, কীর্তনখোলা, কালীদহ প্রভৃতি নদীর প্রতিবেশ আছে কবিতায়। শঙখচিল-লক্ষ্মীপেচাঁ, বিভিন্ন পতঙ্গের কথা ঘুরে ফিরে এসেছে কবিতায়। এসব তো বাংলারই সম্পদ, বাংলারই পরিবেশ।

বনবনানী, গাছাগাছালি ও ফুল হয়েছে জীবনানন্দের অনুপ্রেরণা। কাঁঠাল, জাম, বুনো চালতা, ভাঁটাফুল, বেত, ধুন্দল, হিজল, বট, ডুমুর, আম, অশ্বথ, আকন্দ, নোনাগাছ, নাটাফল, চাঁপা, আনারস, গাব, শটি, বাঁশ, কামরাঙা, কাঁঠালচাঁপা, শ্যাওলা, বাসকলতা, করবী, আখ, শশালতা, সুপারি, কলমির গন্ধভরা জল, শিমুলের ডাল-তাই তো চলে এসেছে কবিতার বুননে। নদনদী, জলাশয়, ঢেউ, পাড়/ তীর, চর ইত্যাদি হয়েছে জীবনানন্দের কবিতার উপাদান। ‘গাঙুড়ের জল, রূপসার ঘোলাজলে হয়তো কিশোর এক সাদা চেঁড়াপালে/ ডিঙা যায়’ (আবার আসিব ফিরে ধানসিঁড়িটির তীরে-এই বাংলায়) চিত্রের শব্দশৈলী/ চিত্রনির্মাণের মাধ্যমে নদীমাতৃক বাংলার প্রতিচ্ছবিই যেন এ-কাব্যের কবিতাগুলো। ‘চড়াই পাখি কাঁঠালীচাঁপার নীড়ে ঠোঁট গুঁজে বসে থাকে’, ‘দুপুরে ঘাসের বুকে সিঁদুরের মতো রাঙা লিচু পড়ে আছে’ (কোথাও চলিয়া যাব একদিন), ‘কামরাঙা লাল মেঘে যেন মৃত মনিয়ার মতো’, ‘কাঁঠাল জামের বুকে রোদ তার চুল ঝাড়ে’ (এখানে আকাশ নীল), ‘আমি ঝরে যাই একদিন কার্তিকের নীল কুয়াশায়’ ইত্যাদির আবহ তো এই বাংলারই। শালিক, হাঁস, লক্ষ্মীপেচাঁ, নিমপাখি, দোয়েল, (রাঙা/ ধবল) বক, হাঁস, শ্যামা, খঞ্জনা, বউ কথা কউ, মুনিয়া, মাছরাঙা, কাক, চকোরী, শঙখচিল, শ্যামার নরম গান কবিতার পরতে পরতে। এসব পাখপাখালি তো বঙ্গজ। আকাশ-বাতাস আর কত্তরকম রূপ! লাল-কমলা-নীল-কালো…। কী নেই ‘রূপসী বাংলা’র কবিতাগুলোতে! বাদুড়, বেজি, ইঁদুর, পিঁপড়ে যেমন আছে গুবড়ে পোকা, ভ্রমর, মৌমাছি, জোনাকি প্রভৃতি কীটপতঙ্গ প্রসঙ্গ। বাস্তুতন্ত্র, ঊপড়ষড়মু বা প্রাকৃতিক ভারসাম্য, জীববৈচিত্র্য ইত্যাদির কথা মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে জীবনানন্দের কবিতায়। এই পার¯পারিক সহ-অবস্থান চিরায়ত বাংলার কথাই মনে করিয়ে দেয়। আমরা যে এখন ‘সবুজ বাঁচাও আন্দোলন’ করছি তা যেন আগেই বলে গেছেন কবি জীবনানন্দ দাশ। হেমন্ত, কার্তিক, শিশির, ধানখেত, কৃষ্ণাদ্বাদশীর জ্যোৎস্না ঘুঙুরের মতো ভাঁটাফুল, নীল তেতুলের বন, কদমের ডালের লক্ষ্মীপোঁটা, বঁইচি শেয়ালকাঁটা বাসকের গন্ধ, গুবরে পোকার ক্ষীণ গুমরানি, তালবন, ভেরেন্ডাফুলের নীল, শাড়ির কস্তা পাড়, ফণীমনসার ঝোঁপ, তমালের বন, ধলেশ্বরীর চরায় গাঙশালিকের ঝাঁক-গ্রামবাংলার কীসের অভাব রেখেছেন তিনি!

উপমা, অলংকার, চিত্রকল্পে যথার্থতার কয়েকটি নমুনা। প্রায় সবগুলির যথর্থতা বা একুইরেসি রয়েছে। ‘বৈশাখ মেঘ-শাদা শাদা যেন কড়ি-শঙ্খের পাহাড়’, ‘ভিজে পেঁচা শান্ত স্নিগ্ধ চোখ মেলে কদমের বনে’, ‘তাদের দেহের গন্ধ চাঁপাফুল-মাথা ম্লান চুলের বিন্যাস’ ইত্যাদি কয়েকটি নমুনামাত্র হতে পারে। এরকম যথার্থতার উপাদান সমস্ত কবিতাতেই বর্তমান। কবিতাগুলি যেন চেরচেনা বাংলার, শ্বাশত গ্রামের। নমুনা হিসাবে আরও কিছু কবিতা (অংশবিশেষ) তুলে ধরা-ই যায়:

বিজ্ঞাপন

(১) হয়তো দেখিবে চেয়ে সুদর্শন উড়িতেছে সন্ধ্যা বাতাসে;
হয়তো বা শুনিবে এক লক্ষ্মীপেঁচা ডাকিতেছে শিমুলের ডালে;
হয়তো খইয়ের ধান ছড়াতেছে শিশু এক উঠানের ঘাসে;
রূপসার ঘোলা জলে হয়তো কিশোর এক শাদা ছেঁড়া পালে
ডিঙা বায়;-রাঙা মেঘ সাঁতরায়ে অন্ধকারে আসিতেছে নীড়ে
দেখিবে ধবল বক: আমারেই পাবে তুমি ইহাদের ভিড়ে।
[আবার আসিব ফিরে]

(২) খয়েরি অশথপাতা-বঁইচি শেয়ালকাঁটা আমার এ দেহ ভালোবাসে
…গভীর ঘাসের গুচ্ছে রয়েছি ঘুমায়ে আমি,-নক্ষত্র নড়িয়ে।
[যখন মৃত্যুর ঘুমে]

(৩) ভিজে হয়ে আসে মেঘে এ-দুপুর-চিল একা নদীটির পাশে
জারুল গাছের ডালে বসে বসে চেয়ে থাকে ওপারের দিকে;
পায়রা গিয়েছে উড়ে চবুতরে, খোপে তার;-শসা লতাটিকে
ছেড়ে গেছে মৌমাছি;-কালো মেঘ জমিয়াছে মাঘের আকাশে,
মরা প্রজাপতিটির পাখার নরম রেণু ফেলে দিয়ে ঘাসে
পিঁপড়েরা চলে যায়;-দুই দন্ড আম গাছে শালিখে শালিখে
ঝুটোপুটি কোলাহল-বউকথাকও আর রাঙা বউটিকে
ডাকো নাকো-হলুদ পাখনা তার কোন যেন কাঁঠালের পলাশে।
[ভিজে হয়ে আসে মেঘ]

বিজ্ঞাপন

(৪) সেখানে সবুজ ডাঙা ভরে আছে মধুকূপী ঘাসে অবিরল;
সেখানে গাছের নাম : কাঁঠাল, অশ্বত্থ, বট, জারুল, হিজল;
সেখানে বারুণী থাকে গঙ্গাসাগরের বুকে-সেখানে বরুণ
কর্ণফুলী ধলেশ্বরী পদ্মা জলাঙ্গীর দেয় অবিরল জল।
[এই পৃথিবীতে এক]

(৫) এখানে আকাশ নীল-নীলাভ আকাশ জুড়ে সজিনার ফুল
ফুটে থাকে হিম শাদা-রং তার আশ্বিনের আলোর মতন;
আকন্দফুলের কালো ভীমরুল এইখানে করে গুঞ্জরণ
রৌদ্রের দুপুর ভরে।
[এইখানে নীল আকাশ]

ইন্দ্রিয়ঘনত্ব জীবনানন্দ দাশের কবিতার অন্যতম প্রবণতা। দৃশ্যচিত্রের অনেকক্ষেত্রে গন্ধ,¯পর্শ ও রসনার স্বাদও দেয়। একই কবিতায় একাধিক ইন্দ্রিয় জাগ্রত হয়। ছবি আঁকার তার এ নিপুণতা আলাদা করেছে। চমৎকারিত্ব এনেছে কবিতায়। শ্রবণ, দর্শন, ¯পর্শ, ঘ্রাণ ইত্যাদি ইন্দ্রিয়ের ব্যবহার লক্ষণীয়। কবির মানস যেন বাংলার প্রকৃতি, প্রতিবেশ। প্রকৃতির প্রাণ, প্রতীক হয়ে উঠেছে কবিতার শরীর। রূপসী বাংলা কাব্যগ্রন্থের কবিতাগুলি তাই, এক-একটি টুকরো-টুকরো গ্রাম। গ্রামগুলি মিলেই বিশাল বাংলা-শ্যামল বাংলা। বাংলার ‘পরণ-কথার গন্ধ লেগে আছে যেন তার নরম শরীরে-এরি মাঝে বাংলার প্রাণ’। কবিতাগুলি যেন প্রতিধনি হয় জীবনানন্দের ইচ্ছের প্রতিধ্বনি ‘আমি এই বাংলার পাড়াগাঁয়ে বাঁধিয়াছি ঘর’।

প্রকৃতির মধ্য দিয়েই জীবনানন্দ দাশ তুলে ধরেছেন আনন্দ-উল্লাস, বিষাদ-অবসাদ, প্রেম-ভালোবাসা-বিরহ, অলসতা, দেশপ্রেম। প্রোজ্জ্বল উপস্থাপনায় ‘রূপসী বাংলা’র কবিতাগুলি সত্যিই হয়েছে বাংলার প্রতিনিধি। নিখাদ বর্ণনায় হয়েছে গ্রামবাংলার শ্রেষ্ঠ প্রতিনিধি। কবিতার অবয়ব যেন বাংলা, শব্দগুলি যেন এক-একটা পরিবেশের চিত্র। চমৎকার উপস্থাপন ও তথ্যাদির যথার্থতা এ-কাব্য যেন ‘বাংলাদেশ’। কবিতাগুলি যেন এক-একটা আর্কাইভ।

লেখক : কবি ও প্রাবন্ধিক

সংশ্লিষ্ট সংবাদ:

ট্যাগ:

শীর্ষ সংবাদ:
শেখ হাসিনা ভারতে আছেন থাকবেন রাতেই কুমিল্লা’সহ দশ অঞ্চলে ঝড়-বৃষ্টির আভাস দুই ঈদে ১১ দিন ও দুর্গাপূজায় ছুটি মিলবে দুই দিন ১৫ বছর দেশের সব মানুষ নির্যাতিত ছিল: জামায়াত আমির স্বামীর কবরে চিরনিদ্রায় শায়িত হলেন মতিয়া চৌধুরী চাঁদপুর কারাগারের সাজাপ্রাপ্ত আসামির মৃত্যু হালাল উপার্জন অল্প হলেও বরকত থাকে: মিজানুর রহমান আজহারী পল্লী বিদ্যুৎ কর্মীদের ব্ল্যাকআউট, ‘কমপ্লিট শাটডাউনের’ আলটিমেটাম চাঁদপুরে ২৬ জেলে আটক: ১৭ জনের একমাসের কারাদণ্ড  ২০২৫ সালের সরকারি ছুটির তালিকা প্রকাশ সাকিবকে নিয়েই বাংলাদেশের দল ঘোষণা বঙ্গবন্ধুকে জাতির জনক মানা নিয়ে যা বললেন উপদেষ্টা নাহিদ ঢাবি ক্যাম্পাসে হেঁটে হেঁটে গ্রাফিতি দেখলেন ড. ইউনূস সম্পত্তিগত বিরোধ: মতলব উত্তরে ছেলের ছুরিকাঘাতে বাবা নিহত চাঁদপুরে বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানকে ১৮ হাজার টাকা জরিমানা চাঁদপুরে ১৫ দিনে সাপের কামড়ে আহত অর্ধশত, একজনের মৃত্যু  এক দফা দাবিতে বাংলাদেশ মাধ্যমিক সহকারী শিক্ষক সমিতির আন্দোলন হাজীগঞ্জের বড়কুল পুর্ব ইউনিয়ন আইডিয়াল ক্লাব ও পাঠাগারের উপদেষ্টা ও কার্যকরি কমিটি গঠন হাজীগঞ্জে প্লাস্টিকের ব্যাগ ব্যবহার ও লাইসেন্স নবায়ন না করায় তিন প্রতিষ্ঠানে জরিমানা হাজীগঞ্জে গাছ থেকে পড়ে ও পানিতে ডুবে শিশু’সহ দুই জনের মৃত্যু