ছাত্র রাজনীতীর সেকাল
আমাদের সময়টার কথাই বলি। আমরা যখন ছাত্র রাজনীতি শুরু করি, ছাত্রলীগের সভাপতি হিসেবে আমরা পেয়েছি সত্য ব্রত ভদ্র মিঠুনদাকে আর সাধারণ সম্পাদক হিসেবে পেয়েছি জহিরুল ইসলাম মামুন ভাইকে। তাঁদের একটা বিশেষ গুণ ছিল। আর তা ছিল তাঁরা সবসময় যেকোন মিছিলের পিছনে থাকতেন, আর সাথে সবসময় ছায়ার মতো তাঁদের সমবয়সী বা কাছাকাছি বয়সের কিছু সিনিয়রদেরও দেখতাম। তাঁদের একটা বিষয় লক্ষ্যণীয় ছিল। আর তা ছিল বিশেষ করে যারা নবাগত তাদেরকে সবসময় মিছিলের সামনে ঠেলে দিতেন। পিছন থেকে পরখ করতেন- কে ভালো স্লোগান দেয়, কে আবেগ দিয়ে মিছিল করে বা কেউ দুষ্টামি করে কিনা।
আরেকটা বিষয় সবসময় তাঁদের মাথায় থাকতো পিছন থেকে যদি কেউ হামলা করে, প্রথম আঘাতটা যেনো তাঁদের উপরেই আসে। পরে মিছিল শেষে খোঁজ নিতেন কে কোথা থেকে আসছে, কিভাবে আসছে। পারিবারিক খোঁজ খবর নিতেন, বাবা কি করে, কেমন আছে , ভাই কি করে, ফ্যামিলি কেমন, পড়া লেখা কোথায় বা কতটুকু, রেজাল্ট কি, সব জেনে শুনে বুজে শেষে পিঠ চাপড়ে সাহস যোগাতেন, আগামীর জন্য উৎসাহ দিতেন।
কিন্তু নবাগতদের ডিটেইলস আত্মস্থ করে নিতেন। বিভিন্ন ইউনিয়ন থেকে যারা প্রোগ্রামে আসতে তারা কিভাবে বাড়ি ফিরবে সবসময় সিনিয়ররা উদ্বিগ্ন থাকতেন। তবে বিশেষ করে মিঠুনদার এ গুনটা অন্যদের চেয়ে একটু বেশীই ছিল। পারলে এখান থেকে ওখান থেকে ১০/২০টাকা করে ধার দেনা করে ১০/১৫ জনকে ৫০ বা ১০০ টাকা মিলিয়ে দিতেন। তবে যে জিনিসটা আমি বেশী লক্ষ্য করতাম– কোন পোগ্রামেই সভাপতি বা সম্পাদকের আলাদা কোন শো আপ থাকতো না। কারো নামে কোন ব্যানার থাকতো না। নেতাদের গায়ে তেমন ভালো দামের কোন জামা বা পাঞ্জাবীও থাকতোনা। পায়ের জুতোটাও থাকত ছেড়া ফাটা কাঁদা মাখা। আর সিনিয়র নেতাদের অধিকাংশের গায়ে থাকতো ঘামের গন্ধ। ভয়ে কোন নেতাই হোটেলে ডুকতে চাইতেন না। কারন ওনাদের পকেটে কখনই ১০/২০ টাকার বেশী থাকতো না।
আবার কোন ইউনিটে প্রোগ্রাম থাকলে একসাথে রওনা হলে কে কার কর্মী সেটাও কখনো কারো বিবেচ্য ছিল না। কোথাও প্রোগ্রাম থাকলে সবাই বেশীর ভাগ ক্ষেত্রেই পায়ে হেটে একযোগে প্রোগ্রামস্থলে চলে যেতাম। সেখানেও নেতাদের পকেটে ৫০/১০০ এর বেশী থাকতো না। এ দিয়ে চলতো সর্বোচ্চ বুট বাদামের আয়োজন। এই হাটার মাঝেই বাদাম খেতে খেতেই প্রোগ্রামে এটেন্ড করা। আর কেউ যদি কোন ডোনেশন করতো সর্বোচ্চ সব মিলিয়ে ২০০/৩০০ হলেই কেবল তা দিয়েই আপ্যায়নের আইটেমে বেশী হলে চা নোনতা, কলা পাউরুটি, অথবা সিঙ্গারা।
পরবতী কালে সভাপতি জহিরুল ইসলাম মামুন ও সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আহম্মদ খসরু। কোন পরিবর্তন নেই। যে কোন প্রোগ্রাম শেষে বড় জোড় মাঝে মধ্যে কোন দিন মাইনু ভাই সিঙ্গারা বা সমুচা কিনে দিতেন অথবা বাবুল ভাই কিছু বিস্কেট বা সিঙ্গারা কিনে দিতেন। চাইনিজ রেস্টুরেন্টতো দুরে থাকুক হোটেলে বসে একবেলা ভাত খেয়েছি বলেওতো মনে পড়েনা। অথচ পোগ্রাম শেষ করে বাজারে এসে কত ক্ষুদার্ত থাকতাম। সেই বাড়িতে গিয়েই নিজের বাবারটা খেয়েই রাজনীতি করতে হতো। কোথাও পোগ্রাম আছে শুনলেই যেন শরীরে আগাম জ্বরের ভাব শুরু হয়ে যেতো। না যাওয়ার যতই ভান ধরতাম কিন্তু যখন সবাই এক জায়গায় জড়ো হতো, না গিয়ে থাকাটাই ছিল দুঃসাধ্য। শত প্রতিকূলতা পেরিয়ে পোগ্রামে উপস্থিত থাকার সে কি যে আনন্দ যা কখনও ভুলবার নয়।
আমাদেরকে যারা বুকে আগলে পিছনে হেটে যারা একেকজন সেনাপতির দায়িত্ব পালন করেছিলেন সেই মালেক ভাই, গাজী মাঈনুদ্দিন ভাই, মান্নান ভাই, মিঠুনদা, চঞ্চল ভাই, বাবুল ভাই, মাসুদ মজুমদার, জনি ভাই, ঝিলন ভাই, বাদল ভাই, সালেহ্ আহম্মেদ তরুন ভাই, আলম মজুমদার, মুরাদ ভাই, ইসমাইল ভাই, কাজী মিঠু ভাই, বিশেষ করে এই কজন আমাদের যেকোন আয়োজনে শত ব্যাস্ততার মাঝেও বরাবরই উপস্থিত থাকতেন।
ওই সময়ে আমি স্থানীয় ভাবে আওয়ামীলীগে যে কজন জ্যেষ্ঠ নেতাদের সান্নিধ্য পেয়েছি দেখতাম এ কজনকে বাদ দিয়ে কেউ-ই চলতে পারতোনা। আওয়ামীলীগের কোন পোগ্রাম হলে একজনকেই দেখা যেতো মুল আয়োজনে। গ্রুপিং বা পছন্দ অপছন্দ যাই থাকুক। তাঁদের যে ক’জনের নাম উল্লেখ করেছি ওনারা সবাই পর্দার আড়ালে কোন না কোন সিনিয়রের স্নেহাস্পদ ও আর্শীবাদ পুষ্ট ছিলেন। কিন্তু ওনারা একজায়গায় হলে কখনোই দলের বিভক্তিটা ওভাবে ফুটে উঠতোনা এবং প্রকাশও পেতোনা।
আমার চাচা মরহুম হোসেন ঈমাম হায়দার তৎকালীন উপজেলা আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক। চাচার একটা বিশেষ গুণ আমার সবসময় পরিলক্ষিত হতো। দেখতাম বিভাজনে যে যত বেশী চাচার কাছ থেকে দুরে থাকতে চাইতো তিনি তত বেশী তার কাছে আত্মসমর্পণ করতেন। আরও বেশী কাছে টানতেন। কোন একজন প্রোগ্রামে না আসলে প্রোগ্রামে শেষে সময় করে দু’চারজন নিয়ে তার বাড়ি পর্যন্ত চলে যেতেন। বিভক্তি বলতে তখন বুজতাম সামান্য খুনসুটি নিয়ে নেতার বিরুদ্ধাচরণ নয় তা ছিল নেতার সাথে অভিমান। আর নেতাও সেটা বুজতেন। আর তাতে সিনিয়র নেতাদের মান ভাঙ্গানোর যে কৌশল সত্যিই তখন অনুপ্রাণিত হতাম। মনে হতো নেতা নয় যেন দলের একজন বিশ্বস্ত কর্মী হওয়াটাই তখন ছিল আনন্দের সবচাইতে গৌরবের।
দলে গুরুত্বপূর্ণ কোন দায়িত্বের জন্য ব্যাক্তিগত ভাবে কখনোই কোন লোভ বা লালসা আমার ভেতরে কখনোই কাজ করেনি। দলের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালনটা আমার কাছে সবসময় মনে হতো সবচাইতে বেশী কষ্টের। কারণ আমার বাবারতো তেমন কোন জমিজমা নেই, আমারতো তেমন কোন অর্থকড়ি নেই। কি করে দলের খরচ মিটাবো এটাই ছিল দুঃস্বপ্নের কারণ। এছাড়াও ঐ সময়ে দলে যারা শীর্ষ পদে সবাই স্ব স্ব পরিবারে অভিযুক্ত। বাবা মায়েদের কত অভিযোগ কত আহাজারি- ছেলে পরিবারকে পথে বসিয়েছে, সব ধ্বংস করে দিয়েছে, জমি জমা বিক্রি করে সব নিয়ে এসেছে, পরিবারের সবাইকে শেষ করে দিয়েছে, সব শেষ, সব শেষ। খোদার কাছে বাপ মায়েরা আর্শীবাদ করতো কবে জানি তাদের ছেলেটা রাজনীতি থেকে সরে দাঁড়াবে বা সরে আসবে।
আর একটা পরিবারকে শেষ করে দিয়ে, নিঃস্বার্থ ভাবে যে তার নিজের সোনালী অতীতটাকে নিজের প্রয়োজনে কাজে না লাগিয়ে, পরিবারের সব শেষ করে দেয়া বাবা মা ভাই বোনদের ঘৃণিত, হাজারো অভিযোগে অভিযুক্ত, অভিশপ্ত সেই ছেলেটির রক্তে ঘামে শ্রমেই তখনকার ছাত্রলীগ। আর আজকের এই আওয়ামীলীগ।
লেখক- সাংগঠনিক সম্পাদক, হাজীগঞ্জ পৌর আওয়ামীলীগ।