ব্যবসায়ীদের কি নীতি-নৈতিকতা থাকতে নেই !
গতবছর ভারত বাংলাদেশকে পেঁয়াজ দিবে না এমন একটি ঘোষণায় ৪০ টাকার পেঁয়াজ সন্ধ্যায় ১০০ থেকে১২০ টাকা বিক্রি শুরু হয়। এ ঘটনায় পেঁয়াজের বাজার এত অস্থির হয় যে, অল্প কয়দিনে পেঁয়াজের দাম লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়তে শুরু করে। শেষ পর্যন্ত প্রতি কেজি পেঁয়াজ ২৫০ থেকে ৩০০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়েছে। সরকার বাজারের চাহিদা সংকট নিরসনের জন্য অন্য দেশ থেকে পেঁয়াজ আমদানি করেও শেষ পর্যন্ত অসাধু ব্যবসায়ীদের জন্য বাজার নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়নি। ইম্পোর্টার আড়ৎদার ও মজুদদারদের কারসাজিতে বেশ কয়েক মাস চওড়া মূল্যে ক্রয় করতে বাধ্য হয়েছেন ক্রেতাসাধারণ। বাজারে তখনও প্রচুর পরিমাণে মজুদ থাকা সত্ত্বেও মজুমদাররা অতি মুনাফায় বিক্রি করতে গিয়ে ক্রেতা সাধারণের নিকট চাহিদা সীমিত হয়ে আসে। ফলে মজুতদারদের পেঁয়াজ গোডাউনে পঁচতে শুরু করে।
পেঁয়াজের সবচেয়ে বড় আমদানিকারক বাজার চট্টগ্রাম খাতুন বাজার। যেখান থেকে সারাদেশে পেঁয়াজ সরবরাহ হতো। অতি মুনাফায় বিক্রির আশায় মজুদকৃত পেঁয়াজ গোডাউনেই পঁচে গলে যায়। চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জ বাজার সংলগ্ন ডোবা, নালা নর্দমায় শেষ পর্যন্ত শত শত বস্তা পচা পেঁয়াজ ফেলে রেখে যেতে দেখা যায়। যারা ন্যায্যমূল্যে মানুষকে পেঁয়াজ খেতে না দিয়ে অতিমুনাফার আশায় পঁচিয়ে ডোবা নর্দমায় ফেলে দেয়, এমন অসাধু ব্যবসায়ীদেরকে মানুষ বললে প্রকৃত মানুষের অসম্মান করা হবে। এ সকল অসাধু ব্যবসায়ীরা একেকবার একেক পণ্য দিয়ে এভাবে রাতারাতি কোটিপতি হয়। আর প্রশাসন মাঝে মাঝে নামমাত্র অভিযান চালিয়ে সামান্য কিছু জরিমানা করেই দায়িত্ব পালন শেষ করে। এতে এ সকল অসাধু ব্যবসায়ীরা সামান্য জরিমানাটাকে কোনো কর্ণপাত করেন না। কারণ যে জরিমানা হয়, তা তাদের হয়তো এক আদ ঘন্টার মুনাফার টাকা।
অতি সম্প্রতি বৈশ্বিক মহামারি করোনা ভাইরাসে যখন আমাদের দেশেও সনাক্ত শুরু হয়, একটা পর্যায়ে এসে সরকার কাঁচাবাজার, মুদি দোকান, ওষুধের দোকান বাদে সকল ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করেন। এতে দেশের মানুষের বড় একটা অংশ বেকারত্ব বরণ করতে হয়। নিম্নআয়ের লোকদের সরকার খাদ্য সামগ্রী দিলেও বেশিরভাগ মানুষ যেভাবেই হোক পারিবারিক ব্যয় তাদের নিজেকে বহন করতে হচ্ছে। দেশের এমনই এক ক্রান্তিকালে ব্যবসায়ীরা আদা নিয়ে বড় ধরনের কারসাজি শুরু করে। চট্টগ্রাম ইম্পোর্টারদের নিকট জেয়াদা ৯৭ টাকা পড়েছে, স্থানীয় বাজারে সে আদা ২৫০ থেকে ৩৫০ টাকা পর্যন্ত ক্রেতারা ক্রয় করতে বাধ্য হয়েছে। এর মধ্যে ঢাকা শ্যামবাজার কয়েকটি বড় বড় দোকানে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ কর্তৃপক্ষ সামান্য জরিমানা ও মূল্য নির্ধারণ করে দিলেও বেশিরভাগ ব্যবসায়ীরা অধরাই রয়ে যায়। আর এই দুঃসময়ে মানুষ শেষ পর্যন্ত চড়া মূল্যেই এ সময় অতি প্রয়োজনীয় পণ্যটি কিনতে হয়েছে। কালে কালে, সময়ে সময়ে ব্যবসায়ীরা অতি মুনাফার জন্য এমন কাজ করলেও সরকারের পক্ষ থেকে অজ্ঞাত কারণে এদের লাগাম টেনে ধরতে ব্যর্থ হচ্ছে। আর লাগাম টেনে ধরবেই বা কি করে? যদি এই ব্যবসায়ীরা হয় হাজী, রাজনীতিবিদ, আর মন্ত্রী-এমপিদের ঘনিষ্ঠ ও আত্মীয় স্বজন। সম্প্রতি করোনাকে কেন্দ্র করে এবং রমজানকে সামনে রেখে মুদি ব্যবসায়ীরা যে হারে অতি মুনাফায় ক্রেতাদের নিকট পণ্যদ্রব্য বিক্রয় করেছেন তা নজিরবিহীন।
জনমানুষের মুখে মুখে শোনা যায় এ করোনা প্রাদুর্ভাবকে কেন্দ্র করে কিছু ব্যবসায়ী ও মুদি দোকানদাররা রাতারাতি কোটিপতি বনে গেছেন। শুধু পেঁয়াজ, রসুন , আদা, আর মশলা নয়, চাল-ডাল মুরি সহ নিত্যপ্রয়োজনীয় সবকিছুই এ দুর্যোগের সময় ক্রেতাদের ক্রয় করতে হয়েছে চড়া দামে। দেশে সব ধরনের খাদ্য-সামগ্রীই প্রচুর মজুদ রয়েছে।সরকারের এমন ঘোষণার পরও বাজার থেকে নিত্য প্রয়োজনীয় খাদ্যসামগ্রী মানুষকে ক্রয় করতে হয়েছে অধিক মূল্যে। এটা অত্যন্ত দুঃখজনক! এতদ্বসত্ত্বেও সরকারের পক্ষ থেকে এদের লাগাম টেনে ধরা সম্ভব হয়নি। দেশের দুর্যোগ মুহূর্তে যেখানে মানুষ হিসেবে ব্যবসায়ীরা মানবিক হওয়ার কথা ছিল, সেখানে তারা রীতিমত অতিমুনাফায় খাদ্য সামগ্রী বিক্রি করে অমানবিক কাজ করেছে। সে ক্ষেত্রে আসলে তাদেরকে প্রকৃত মানুষ হিসেবে গণ্য করতে ঘৃণা হচ্ছে। ব্যবসায়ীদের কি নীতি-নৈতিকতা থাকতে নেই! আমরা মুসলমান হিসেবে যেটা জানি, ব্যবসাকে আল্লাহতালা হালাল করেছেন। প্রকৃত ব্যবসা ইবাদতের শামিল। অন্য ধর্মালম্বী ব্যবসায়ী যারা রয়েছেন, তাদেরকেও তার ধর্ম ভালো কাজটি করার ব্যাপারে উৎসাহিত করেছেন। অথচ আজকাল আর ব্যবসা বাণিজ্য করতে গিয়ে হালাল-হারাম চিন্তার বালাই নেই। যে যত বেশি ক্রেতার পকেট কেটে নিতে পারেন।
মনে হয় যে এধরনের একটা প্রতিযোগিতায় ব্যবসায়ীরা লিপ্ত রয়েছেন। কিছু কিছু ব্যবসায়ীদের দেখেছি প্রশাসনের অগোচরে ক্রেতাদের নিকট অতি মুনাফা পণ্য বিক্রি করছে। আবার যখন আযান দেয়, সবার আগে গিয়ে সামনের কাতারে গিয়ে নামাজটা আদায় করে আসছেন। জানিনা তাদের এই ইবাদত আল্লাহর নিকট কতটুকু কবুল হবে। তবে এতটুকু জানি,পরের হক নষ্টকারীর জন্য আল্লাহ নিজে ক্ষমা করার অধিকার রাখেননি।
দেশে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন বলতে একটি আইন আছে। এর আসলে কাজটা কি আমার জানামতে অনেকেই জানেনা। বাজারের শৃঙ্খলা ফেরাতে এবং স্বাভাবিক রাখতে এ আইন সম্পর্কে জনসাধারণকে অর্থাৎ ক্রেতা-বিক্রেতা উভয়কে জানানো উচিত, অবহিত করা উচিত। শুধু তাই নয় এর যথাযথ প্রয়োগ করাও উচিত।
এ আইন বাস্তবায়নের জন্য প্রত্যেক উপজেলায় প্রয়োজনমতো জনবল এবং অফিস থাকাও বাঞ্ছনীয়। আর যারা ব্যবসার নামে একের পর এক ক্রেতা সাধারণের পকেট কেটে যাচ্ছে তাদের শুধু সামান্য জরিমানা করলেই হবেনা, এদের ধরতে জেল-জরিমানা উভয় দণ্ডই রাখা এবং বাস্তবায়ন করা প্রয়োজন। আর তা না হলে মাসের-পর-মাস,বছরের পর বছর এ সকল অসাধু ব্যবসায়ীদের নিকট ক্রেতা সাধারণ শোষিত ও নিষ্পেষিত হতে থাকবে। আর এদের লাগাম টেনে ধরাও সম্ভব হবে না। আমরা সাধারণ মানুষ হিসেবে নামে নয়, বাস্তবে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন এর বাস্তবায়ন চাই।
লেখকঃ-সাংবাদিক, শিক্ষক ও চারুশিল্পী