আনোয়ার মল্লিক, একটি অধ্যায়

জুন ৯, ২০২০ | ১:২৭ অপরাহ্ণ
মোজােম্মল হক চৌধুরী মোহন , পপুলার বিডিনিউজ

মঙ্গলবার বিকালে বীর মুক্তিযোদ্ধা আনোয়ার হোসেন মল্লিক নিয়ে লেখা শেষ করলাম, তখন খবর পেলাম তার স্ত্রী মারা গেছেন। খবরটা শুনে মনটা আরো বিষন্ন হয়ে পড়ল। আনোয়ার হোসেন মল্লিক জন্ম নোয়াপাড়া গ্রামে কিন্তু স্থায়ী নিবাস রামপুরে। তিনি অদ্য ভোর বেলা নিজ বাড়িতে ইন্তেকাল করেন। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহে রাজিউন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৬৫ বছর। তিনি দুই পুত্র এবং দুই কন্যা সন্তানের জনক। ১৯৫৫ সালে জন্মগ্রহণ করা বীর মুক্তিযোদ্ধা আনোয়ার মল্লিক বয়সে এবং লেখাপড়ায় আমার চেয়ে এক বছরের ছোট ছিলেন। অত্যন্ত অমায়িক, মেধাবী, জ্ঞানী, সাহসী, সমাজ-সচেতন এবং প্রগতিশীল রাজনৈতিক চিন্তার অধিকারী ও স্পষ্টবাদী একজন মানুষ ছিলেন। আমি তাকে বন্ধু হিসেবে পেতে চাইতাম। কিন্তু, আবেগপ্রবণ এই মানুষটি অনেক সময় আমাকে বড় ভাই এবং মিঞা ভাই বলে সম্বোধন করতেন। অমায়িক চরিত্রের এই মানুষটির কথা লিখার সময় ৫০ বছরের হাজারো স্মৃতির কথা একে একে স্মৃতির মানসপটে ভেসে উঠছে। দুদিন আগের প্রিয় বিদ্যালয় রামপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রসঙ্গে লিখার সময়েও মনের অগোচরে সহপাঠীদের মাঝে আনোয়ার মল্লিকের নামটি প্রথমে আসে। ঐ লেখা যখন প্রকাশিত হয় তখন সে বেঁচে ছিল কিন্তু আজ নেই। ফজরের নামাজ পড়ে বাসার ভিতরে কিছু পায়চারির পর হঠাৎ মনে হল মোবাইলটা অন করি। অন করার দশ সেকেন্ডের মাথায় মোবাইলটি বেজে উঠে। নিশ্চিত হয়ে গেলাম কোন দুঃসংবাদের খবর হবে।ফোনটি ছিল মাওলানা নজরুল ইসলাম তালুকদারের। তিনি জানালেন আনোয়ার মল্লিক ফজরের নামাজ পড়ার পরেই নামাজের জায়নামাজে ইন্তেকাল করেছেন। আমি ইন্না-লিল্লাহ পড়ে দীর্ঘ নিঃশ্বাস তুলে মাওলানা সাহেবের সাথে মরহুমের মৃত্যু এবং জীবন সংক্রান্ত ব্যপারে কিছু আলোচনা করলাম। পর্যায়ক্রমে একই সংবাদ এলো আক্তার মুন্সী, আনোয়ার উল্লাহ পাটোয়ারী, হাফেজ জসিম, আলমগীর মল্লিক এবং আওয়ামী লীগ সভাপতি মিকন সহ আরো অনেকের কাছ থেকে। সবাই তার ব্যপারে আমার সাথে দুঃখ প্রকাশ এবং সমবেদনা প্রকাশ করলো। এ কথা যখন লিখছি এই সময়ে টেলিফোন করল নোয়াপাড়ার জিয়াউর রহমান জিয়া। জানালো অনেক মানুষের উপস্থিতিতে আনোয়ার মল্লিকের জানাজা এবং দাফন কার্য সম্পন্ন হয় রামপুর পূর্ব বাজারের মসজিদ সংলগ্ন তার নিজস্ব জায়গায় রাষ্ট্রীয় মর্যাদায়। লেখার শুরুতে আমি তাকে মেধাবী বলেছি, কেন বলেছি? এই প্রজন্মের অনেকেই হয়ত জানে না আনোয়ার স্কুল জীবনের সকল শ্রেণিতেই প্রথম স্থানের অধিকারী ছিলেন। স্বাধীনতার পরপর তিনি এসএসসি পাশ করে চাঁদপুর কলেজে ভর্তি হয়ে ছাত্র রাজনীতিতেও সক্রিয় হয়ে পড়েন। কিন্তু দূর্ভাগ্য হলেও সত্য, ওই সময়ে তার পিতা জনাব ওয়াহাব আলী মল্লিকের অকাল মৃত্যু তার পরিবারের উপর বিরাট প্রভাব ফেলে। যেহেতু আনোয়ার মল্লিক ছিলেন পরিবারের জ্যেষ্ঠ সন্তান, তার পরিবারের সকল দায়-দায়িত্ব তাকেই নিতে হয়। বাধ্য হয়ে সে তার পিতার কর্মস্থল হাজিগঞ্জ সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে দলিল লেখক হিসেবে যোগাদান করেন। আমার জানামতে ঐসময়কার এক মাত্র কনিষ্ঠ দলিল লেখক ছিলেন এই বীর মুক্তিযোদ্ধা আনোয়ার মল্লিক। পিতার এই অকাল মৃত্যু তার লেখাপড়ায় বিঘ্ন ঘটায়। আমি যেই পরিবেশে লেখাপড়া করেছি, পরিবার থেকে যে সহযোগীতা পেয়েছি এ সব যদি আনোয়ার পেত তাহলে মেধার বলেই সে শিক্ষার উচ্চ শিখরে পৌছে যেতে পারত। কিন্তু তাতে কি? সে তো জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের একজন। তাকে আমি সাহসী ও জ্ঞানী বলেছি। কেন বলব না? ১৯৭১-৭২ এ যখন সবেমাত্র সে স্কুলের ছাত্র তখন ই তো সে এলাকার কলেজ পড়ুয়া অনেক ছাত্রনেতাদের সাথে একই টেবিলে বসার ও কথা বলার সুযোগ করে নিয়েছিল। তাদের মাঝে উল্ল্যেখযোগ্য খিল পাড়ার কামাল হোসেন মজুমদার, শরিফুল্লাহ পাটোয়ারী, দোয়ালিয়ার আবুল ফারাহ, মৈশাইদের জহির ভাই, মুক্তিযোদ্ধা ওহিদুল্লাহ মজুমদার সহ আরো অনেকে। এরা সবাই আমারো সিনিয়ার। [caption id="attachment_2519" align="alignleft" width="300"] আনোয়ার মল্লিক, একটি অধ্যায়, লিখেছন- মোজােম্মল হক চৌধুরী মোহন[/caption] ভোরবেলা তার মৃত্যুসংবাদ পেয়ে যখন দু একজনের সাথে কথা বলছিলাম এমন সময় আমার সহধর্মিণী আমার কক্ষে এসে আমাকে বলে, "আনোয়ার ভাই একজন ভালো মানুষ ছিলেন, তিনি তো হজ্জে যাওয়ার আগে আমাদেরকে তার বাসায় অনুষ্ঠিত মিলাদ মাহফিলে দাওয়াত করেছিলেন। যথাসময়ে ঐ দাওয়াতে আমার একমাত্র কন্যা সহ অংশগ্রহণ করায় তিনি অনেক খুশি হয়েছিলেন।'' উল্লেখ্য রামপুর বাজারে আমি অনেকের বাড়িতে গিয়েছি, থেকেছি এবং খেয়েছি। কিন্তু যে দুজনের বাড়িতে আমি আমার পরিবারকে নিয়ে গিয়েছি এবং খেয়েছি তাদের মধ্যে একজন হলেন এই আনোয়ার মল্লিক আরেকজন হল আমিন ভুইয়া। দুজনেই আজ আর নেই। দীর্ঘ পঞ্চাশ বছর সম্পর্কের উল্লেখযোগ্য ঘটনাসমূহ যদি আলোচনা করি তা আর অধ্যায় থাকবে না হয়ে যাবে ইতিহাস। করোনার এই কঠিন মূহুর্তে এত দীর্ঘ লেখা পড়ার ও হয়ত অনেকের ধৈর্যে কুলাবে না। তাই সংক্ষিপ্ত করার চেষ্টা করছি। জীবনের একটি সময়ে সে ছিল আমার বিশ্বস্ত একজন। সে যখন চলার পথে আমার পাশে থাকত অনেক অসাধ্য কাজ ও সহজ হয়ে যেত। এ প্রসঙ্গে দু একটি ঘটনার উল্লেখ করতে চাই। সে পাশে থাকাতেই ১৯৭৩ সালে রামপুর থেকে দুজনে পায়ে হেঁটে নারায়ণপুর বাজারে যাই এবং সেখানে একটি সভা করে হ্যান্ড মাইক নিয়ে রাজনৈতিক প্রচারণা চালাতে চালাতে আবার রামপুর এসে পৌছি। একথা ভাবতে এখন আমার ই অবাক লাগে। আরেকটি ঘটনা ১৯৮১-৮২ তে একটি সামাজিক প্রয়োজনে লোকাল বাসে মুদাফফরগঞ্জ নেমে রিকশাযোগে মাগরিবের পরে কোর্ট চিতৈষীতে পৌছি তৎকালীন ২২নং ইউপি চেয়ারম্যান শাহাবুদ্দিন সাহেবের অফিসে। সেখানে রাত ১০ টা পর্যন্ত আলোচনা চলে। আলোচনা যখন শেষ হয় তখন ফিরে আসার মত কোন যানবাহন ছিল না।পায়ে হেঁটে ৮-১০ জন আমরা রওনা দেই। আনাতলী বাজার হয়ে মেহের রেল স্টেশনে যখন পৌছাই তখন বাজে রাত ২ টা। আমরা সবাই ক্ষুধার্ত হয়ে পড়ি। ভাগ্যক্রমে স্টেশনের পাশেই একটি খাবার দোকান ছিল।আমরা সেখানে নিশ্চিন্তে খেতে বসি। খাওয়া অর্ধ সমাপ্ত অবস্থায় হঠাৎ দেখি পূর্ব দিক থেকে যাত্রীবাহী একটি ট্রেন আসছে। এ যেন সোনায় সোহাগা। খাওয়া ফেলে আমরা তড়িঘড়ি করে ট্রেনে উঠে বিনা টিকিটে বলাখাল স্টেশনে নেমে পায়ে হেটে রামপুর বাজারে আসি। এই সবই সম্ভব হয়েছিল আনোয়ার মল্লিক পাশে থাকার কারণে। লেখাপড়ার পাশাপাশি সে একজন সংস্কৃতি মনা ও খেলাধূলায় পারদর্শী ছিলেন। তাকে নিয়েই ১৯৭৭ এ রামপুর থেকে ভলিবল প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের জন্য (দীর্ঘ এক মাস ব্যাপী) রামপুর থেকে নারায়ণপুর বাজার এ যেতাম। খেলা শেষে দলবল নিয়ে পায়ে হেঁটে আবার বাড়ি ফিরতাম। এ কথা এ প্রজন্মের অনেকের কাছেই অবিশ্বাস্য মনে হবে। কিন্তু আনোয়ার নেই এই উল্লেখিত কাজের সাক্ষ্মী হিসেবে বেঁচে আছেন বীর মুক্তিযোদ্ধা নওহাঁটার জয়নাল, আমার গ্রামের নজু কাজী, মুন্সীরহাটের রুসুল আমিন, নারায়ণপুরের হালিম, জব্বার এবিং জাহাঙ্গীর সহ আরো অনেকে। এসবই আজ স্মৃতি। লেখার শুরুতে তাকে আমি অমায়িক বলেছি। কেন বলেছি? একবার আমার মাকে রামপুর বাজার দেখতে পেয়ে এগিয়ে আসেন। আমার মায়ের সাথে একটি ব্যাগ ছিল। যা মায়ের একার পক্ষে বহন করা সম্ভব ছিল না। মায়ের সাথে কোন সঙ্গী ও ছিল না। আনোয়ার ব্যাগটি নিজ হাতে বহন করে বাজার থেকে আমার বাড়ি পর্যন্ত পৌছে দিয়ে যায়। মানুষের প্রতি মানুষের ভালোবাসা, শ্রদ্ধাবোধ না থাকলে এরকম কাজ করা সম্ভব হত না। জানি না , এই লেখা যতই দীর্ঘ করি তাতে তার কোন উপকার হবে কি না। উপকার হবে যদি তার দীর্ঘ জীবনের চলার পথের সকল বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন ও পরিচিত জন সবাই যদি তার জন্য দোয়া করেন। একজন সহপাঠী ছোট ভাই, একজন বন্ধু, একজন মুক্তিযোদ্ধা সর্বোপরি একজন মুসলমান হিসেবে আমরা যারা তাকে চিনতাম তাকে জানতাম এবং আমার এই লেখা যাদের কাছে পৌছাবে সবার কাছে মরহুমের জীবনের ভুল ত্রুটির জন্য আমি ক্ষমা চাই এবং দোয়া চাই। আল্লাহ পাক তার সকল ভুল ত্রুটি ক্ষমা করে তাকে জান্নাতবাসী করুক। আমিন।